
ফাইল ছবি Abu Sayeed Khan
বদরুদ্দীন উমর বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়িয়ে তিনি লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে অধিকতর সমাদৃত। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বদরুদ্দীন উমর একজনই; যিনি সত্য উচ্চারণে বেপরোয়া– কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেন না। ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কোনো শাসকের নেকনজরে ছিলেন না, সম্ভবত হাল আমলেও নেই।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার এক উচ্চবিত্ত পরিবারে। বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যিনি ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস নেতা শরৎ বসুর সঙ্গে মিলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ প্রক্রিয়ায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য আবুল কাশেম। বর্ধমানের এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাদের বাড়িতে উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদরা আসতেন। এমনই রাজনৈতিক পরিবেশে উমরের বেড়ে ওঠা। দাঙ্গা, দেশভাগ, বিত্ত-বৈভব ছেড়ে পূর্ববঙ্গে আসা কিশোর উমরকে ভাবিয়েছিল, হয়তো সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিয়োজিত হন বদরুদ্দীন উমর। ’৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতে (মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদ) যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ’৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত পার্টির মুখপত্র গণশক্তি সম্পাদনা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পার্টির লাইনের বিরোধিতা করে পার্টিতে পরপর দুটি দলিল প্রদান করেন। ডিসেম্বরে মতাদর্শিক কারণে ইপিসিপি থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রসার ও নেতৃত্ব গড়ে তোলার কাজে ব্যাপৃত। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘এ দেশে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের তত্ত্ব চর্চা ও নির্মাণ আমি করেছি, সাংগঠনিক কাজেও অন্ত রাখিনি এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, যাতে এই চর্চার চেষ্টায় অন্যরাও অংশগ্রহণ করেন। আমি যা কিছু লিখেছি তা সাহিত্য চর্চা নয়, তার সব কিছুই আমার রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে। বামপন্থিদের এই সহযোগিতার অভাব এবং বিরোধিতার মধ্যেই আমি আমার রাজনৈতিক কর্তব্য বলে যা মনে করেছি, তাই করেছি।’ এই আন্তরিক প্রচেষ্টা ছোট করে দেখবার সুযোগ নেই। তবে তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রম ততটা আলোড়িত হয়নি, যতটা হয়েছে গবেষণা ও বুদ্ধিবৃদ্ধিক কার্যক্রম।
বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন প্রচুর। ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, রাজনীতিকসহ নানা পেশার মানুষ তাঁর গ্রন্থের পাঠক। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁর ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা।
বদরুদ্দীন উমরের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম পাকিস্তান আমলেই। ষাটের দশকের শেষার্ধে আমি ছাত্রলীগের কর্মী। তখন জামায়াত, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ পাকিস্তানপন্থি দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে রাজনৈতিক বাহাস হতো। বদরুদ্দীন উমরের সাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা ও সংস্কৃতির সংকট গ্রন্থ তিনটি থেকে মোক্ষম জবাব খুঁজে পেতাম। বই ত্রয় আমাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ-ভাবনার খোরাক জুগিয়েছিল। এ কথা আমি বদরুদ্দীন উমরের ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বলেছিলাম। এও বলেছিলাম, সে বিবেচনায় বদরুদ্দীন উমর বাঙালি জাতীয়তাবাদেরও তাত্ত্বিক। এর মানে এই নয়, উমর বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী, সর্বহারার মতবাদ মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদের অনুসারী।
বদরুদ্দীন উমরের বইয়ের সংখ্যা প্রায় একশ। তিনিই সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের ওপর গবেষণা করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামে তিন খণ্ড বই রয়েছে। এটি বিশাল কাজ। রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসও তুলে ধরেছেন। তাঁর আলোচিত বইয়ের মধ্যে আরও রয়েছে– চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ, যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ, বাঙলাদেশের অভ্যুদয়, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের জয়পরাজয় প্রভৃতি।
বিদ্যাসাগর থেকে কৃষক, দাঙ্গা থেকে দেশভাগ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ– সবকিছুর নির্মোহ বিশ্লেষক তিনি। তাঁর লেখার সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ আছে, উপেক্ষার উপায় নেই। তিনি তিন খণ্ডের (১৫৫০ পৃষ্ঠা) আত্মজীবনী লিখেছেন। এতে রয়েছে তাঁর জীবন, পরিবার, সমাজ ও রাজনীতি; যাকে বলা যায়, সমাজ ও রাজনীতির শতবর্ষের এক অনন্য দলিল।
বদরুদ্দীন উমরের জীবন বর্ণাঢ্য। তাঁর খ্যাতি দেশের বাইরেও। তিনি কলকাতা, ব্যাসেলস, হাইডেলবার্গ, বার্লিন বিশ্বদ্যিালয় এবং লন্ডন, অক্সফোর্ড, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে বক্তৃতা করেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। ২০০৪ সালে মুম্বাইতে ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরামের সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সম্মেলন উদ্বোধনের আগের রাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমার ঘুম ভাঙালেন। বললেন, ‘তুমি কি জানো, ডব্লিউএসএফের সম্মেলনের পাশাপাশি মার্কসিস্ট-লেনিনিস্টদের একটি বিকল্প সম্মেলন হচ্ছে। সেটি উদ্বোধন করবেন আমাদের বদরুদ্দীন উমর।’ সেখানেও নাম নিবন্ধন করলাম। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সেনানায়ক লক্ষ্মী সায়গল ডব্লিউএসএফের সম্মেলন উদ্বোধন করেন। এর কিছুক্ষণ পর বিকল্প সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়। সেদিন সারা দুনিয়া থেকে আসা মার্ক্সবাদীরা উমরের দেওয়া সাবলীল-উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতায় উদ্বেলিত ও রোমাঞ্চিত হয়েছিল; সে দৃশ্য এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
বদরুদ্দীন উমর জীবনের ৯৩টি বসন্ত পেরিয়েছেন, এবার পা দেবেন ৯৪-এ। এখনও তাঁর স্মৃতি প্রখর। কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে লেনিনকে নিয়ে লেখা কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের দীর্ঘ উর্দু কবিতা স্মৃতি থেকেই আবৃত্তি করেন। তবে শ্রবণশক্তি কমে এসেছে। মাস ছয়েক আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। নানা বিষয়ে কথা হলো। ক্ষোভ ও যন্ত্রণাও প্রকাশ করলেন। এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদের প্রসঙ্গ এলো। তাঁর প্রশংসা করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ।
বর্ধমান থেকে ঢাকা, দীর্ঘ পথ চলা। শহর থেকে গ্রাম, সুরম্য অট্টালিকা থেকে কৃষকের পর্ণকুটিরে রাত্রিযাপন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত। তবে যাপিত জীবন নিয়ে তাঁর কোনো আপসোস নেই। তিনি মনে করেন, ‘আই হ্যাভ লিভড দ্য লাইভ দ্যাট আই ওয়ান্টেড টু লিভ। মডেস্ট, অনারেবল অ্যান্ড প্রোডাকটিভ। আমি সেই জীবনই যাপন করেছি, যা যাপন করতে চেয়েছি। সাধারণ, সম্মানজনক ও উৎপাদনমুখর।’ (সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকার; ২০ ডিসেম্বর ২০২১)
পরিশেষে বলব, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যখন আপসকামিতা, সুবিধাবাদিতা, অবক্ষয় চারদিকে; তখন গর্ব করার মতো একজন বদরুদ্দীন উমর আছেন, থাকবেন। যাঁর কাছ থেকে সাহস নিয়ে, শক্তি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, পারে না আপসের কানাগলি থেকে বেরিয়ে আসতে?
আবু সাঈদ খান: লেখক ও গবেষক; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
[email protected]