Logo
×

Follow Us

প্রবন্ধ

যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে তা দিতে হবে

আবু সাঈদ খান

আবু সাঈদ খান

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ২২:১৫

যার যতটুকু প্রাপ্য, তাকে তা দিতে হবে

ফাইল ছবি Abu Sayeed Khan

আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের দুটি পর্ব– ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। ইতিহাসের প্রথম পর্ব ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা নেই। আমাদের ইতিহাসচর্চা পাকিস্তান আমলে সংগঠিত আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

যে দল যখন ক্ষমতায় আসে, সে দল তার মতো করে ইতিহাসের বয়ান (ন্যারেটিভ) প্রচার করে। আওয়ামী লীগ একটানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। যে কারণে নতুন প্রজন্ম তাদের বয়ানটির সঙ্গে পরিচিত। সেটি হচ্ছে এ রকম– ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তিনি ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন করেন। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ সালে তাঁর নির্দেশে ছাত্ররা শিক্ষা আন্দোলন করে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁকে বন্দি করে। ১৯৬৯ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে যখন গড়িমসি শুরু করে, তখন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন– এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি নির্দেশ দেন– ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ২৫ মার্চ গ্রেপ্তারের আগে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে।’

এ বর্ণনার মধ্যে অসত্য আছে, অতিরঞ্জন আছে, অতিকথনও আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নায়কের অবদান আড়াল করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ গঠনে উদ্যোক্তাদের মধ্যে শেখ মুজিব একজন, তবে মূল উদ্যোক্তা শামসুল হকই। মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যখন আওয়ামী লীগ (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) গঠিত হয়, তখন শেখ মুজিব জেলে ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক বিবেচনায় তাঁকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লেও বোঝা যায় যে, তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ নন। 
একসময়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি থাকত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিশাল প্রতিকৃতির নিচে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের ছোট সাইজের প্রতিকৃতি  থাকত। এটি ছিল শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাকে বড় করতে অন্যদের ছোট করার  হীন চেষ্টার অংশ। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ইতিহাসের মাইলফলক। এর মূল নায়ক ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আওয়ামী লীগের বয়ানে তাদের অবদানের কথা বলা হতো না। তখন বেতার-টেলিভিশনে বলা হতো না মুক্তিসংগ্রামে মওলানা ভাসানীর অবদানের কথা। বামদের ভূমিকাও অগ্রাহ্য করা হতো। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যে তাজউদ্দীন আহমদ ৯ মাসের সশ্রস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিলেন, তিনিও ছিলেন আওয়ামী বয়ানে উপেক্ষিত। 
আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলতেন। অথচ জিয়াউর রহমান একজন সেক্টরপ্রধান, বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ঘটনা। শেখ হাসিনা স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে একাধিকবার সিরাজুল আলম খানকে ষড়যন্ত্রকারী বলেছেন। ইতিহাস সাক্ষী, ষাটের দশকে সিরাজুল আলম খান ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করে ছাত্র-যুবকদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনিই ৬ দফার সংগ্রামকে ১ দফায় পরিণত করার মূল কারিগর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা– ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং ৩ মার্চ পল্টনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। তা ছিল নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত।

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল– সত্য। তবে এটি এক দলের যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধে ভাসানী ন্যাপ, মোজাফ্ফর ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বাম দল যোগ দিয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মণি সিংহ ও মনোরঞ্জন ধর মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। 

সব দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, নূরুল আমিনের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পাটি (পিডিপি) ও মুসলিম লীগের তিন গ্রুপ ছিল ‘পাকিস্তান-পছন্দ’ দল। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। বলা আবশ্যক, আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টিও (ইপিসিপি) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলেছিল। দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের তত্ত্ব দিয়েছিল। এ রাজনৈতিক লাইনের কারণে ইপিসিপিতে ভাঙন দেখা দেয়। এ দলের কর্মীদের একাংশ যশোর, নোয়াখালীসহ কোনো কোনো স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। এ ছাড়া কাজী জাফর, হায়দার আকবর খান রনো ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি ও সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি  মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

সব দলের বয়ানেই উপেক্ষিত জনগণের অবদান। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। একাত্তরে বাঙালি সেনারা অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরেছিল; ছাত্ররা কলম ছেড়ে অস্ত্র ধরেছিল; শ্রমিকরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তখন তরুণদের কানে কবির অমোঘ বাণী ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল– ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার’ (হেলাল হাফিজ)। তারুণ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কৃষক সন্তানরা সর্বাধিক। কৃষকের পর্ণ কুটির পরিণত হয়েছিল দুর্গে। কিষান তাদের গৃহে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিষানি মা পরম মমতায় মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন। যাদের কিছু করার ছিল না, সেই প্রবীণ নর-নারী হাত তুলে প্রার্থনা করেছেন। কিশোররা পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধির ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে লাখ লাখ নর-নারী-শিশুকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। প্রায় এক কোটি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তারাও জয় বাংলার জয় চেয়েছিল। পাকিস্তানি বন্দি শিবিরে যে নারীরা প্রতিনিয়ত পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতো, তারাও ছিল জয়ের জন্য অপেক্ষমাণ। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, কেরানি, দোকানিরা মুক্তিযুদ্ধে হয়েছিল একাকার।  

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলের তরুণ কর্মীরা যোগ দিয়েছিল। তবে বেশির ভাগ তরুণ সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে ছিল না। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কেএম সফিউল্লাহ্, জিয়াউর রহমান, এম এ জলিল, আবু তাহের, খালেদ মোশাররফ, আবুল মঞ্জুর, চিত্তরঞ্জন দত্ত প্রমুখ। রণাঙ্গনে আরও ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী, মোহাম্মদ ফরহাদ-মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী, টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী, গোপালগঞ্জের হেমায়েত বাহিনী, মাগুরার আকবর বাহিনী, ময়মনসিংহের আফছার বাহিনীসহ বহু স্থানীয় বাহিনী।

এটি স্বীকার্য, মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তবে এ পর্বে শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে যায় তাজউদ্দীন আহমদ ও সিরাজুল আলম খানের নাম। ছোট করে দেখা যাবে না মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, সিরাজ সিকদার প্রমুখ বাম নেতার অবদান। ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন এমএজি ওসমানী, জিয়াউর রহমান, সফিউল্লাহ্, আবুল মঞ্জুর, মেজর জলিল, আবু তাহের, খালেদ মোশাররফ, সিআর দত্ত প্রমুখ বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭-উত্তর শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হককে ঘিরেই মুক্তির স্বপ্নবীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, একাত্তরে যা মহিরুহে পরিণত হয়। মুক্তিসংগ্রামে যার যতটুকু অবদান, রাষ্ট্রকেও তার স্বীকৃতি দিতে হবে; যথাযোগ্য সম্মানও দিতে হবে।

বীর মুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদ খান: উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল 


Logo