সমকালীন প্রসঙ্গ
টিপ, হিজাব ও পোশাক পছন্দের স্বাধীনতা
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৩৯

আবু সাঈদ খান
ঘটনাটি সবার জানা- গত ২ এপ্রিল কলেজ শিক্ষিকা লতা সমদ্দার এক পুলিশ সদস্যের হেনেস্তার শিকার হন। ওই কনস্টেবল লতার কপালের টিপ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। পুলিশি তদন্তেও এর প্রমাণ মিলেছে। এই গর্হিত অপরাধের জন্য অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত হবে বলে প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে বিশ্বাস করি, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের শাস্তি হলেই যে নারীর কপালের টিপ, গায়ের পোশাক ও চলন-বলন নিয়ে কটূক্তি বন্ধ হবে; তা নয়। নারীর প্রতি বিদ্বেষ এক শ্রেণির লোকের মগজের মধ্যে রয়েছে। এসব লোক নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারা নারীকে গৃহে বন্দি রাখতে চায়; সেবাদাসী হিসেবে দেখতে চায়। তারা চায় না, নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক; চাকরি-বাকরি করুক; পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠুক। নারীর স্বাধীন পদচারণায় তাদের গাত্রদাহ হয়। তাই কখনও নারীর পোশাক নিয়ে, কখনও কপালের টিপ নিয়ে কটূক্তি করে। কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে নারীবিদ্বেষ উস্কে দেওয়া হয়। ফেসবুক-ইউটিউবে এর প্রতিধ্বনি শুনছি।
নারীবিদ্বেষীদের পাকিস্তান আমলেও দেখেছি, এখনও দেখছি। সংখ্যায় বেড়েছে, না কমেছে; বলা কঠিন। তবে পাকিস্তান আমলে নারী আন্দোলন জোরদার ছিল। ব্রিটিশ ভারতে বেগম রোকেয়া নারী স্বাধীনতার যে সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন; পাকিস্তান আমলেও তা অব্যাহত ছিল। দেশে তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল। বাংলার নারীরা কপালে টিপ এঁটে শাড়ি পরে বাঙালিয়ানাকে সমুন্নত রাখতেন। সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকারী নারীদের মুখে শুনেছি; পাকিস্তানিদের থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরতে তারা শাড়ি পরে কপালে বড় আকৃতির টিপ লাগিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন।
এটি সত্য যে, স্বাধীনতাউত্তর নারীরা ব্যাপকভাবে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। নানা ক্ষেত্রে নারী অগ্রগামী হয়েছে। সমানতালে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনও বেড়েছে। কূপমণ্ডূকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, পুরুষতান্ত্রিকতাও বেড়েছে। এ সবকিছুই এখন একাকার। এ জন্য অপরিকল্পিত, ত্রুটিপূর্ণ, বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা যে বহুলাংশে দায়ী- তা নিয়ে সংশয় নেই। এই শিক্ষা কেরানি ও কারিগর তৈরি করছে; মানুষ গড়ছে না। বরং মানুষে মানুষে, নারী-পুরুষের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল তুলছে।পাকিস্তান আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল, তবে এত ব্যাপক ছিল না। সেখানে শুধু ছেলেরাই পড়ত; এখন মেয়েদেরও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হচ্ছে। এর ফলে নারীদের একাংশের আধুনিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে পরিচয় ঘটছে না। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের শেখানো হচ্ছে না- তারাও সমমর্যাদার নাগরিক। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষার কারণেই নারীমুক্তির দাবিতে সব নারী সোচ্চার হবে না। হচ্ছেও না। এমনকি, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক নারী নিজেদের সমঅধিকারের দাবিকে সমর্থন করছে না। সামাজিক মাধ্যমে দেখি, অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীও নারীবিদ্বেষীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। অতীতে নারীবিদ্বেষী কার্যকলাপ রুখে দিতে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল; তাতেও এখন যেন ভাটার টান। আমাদের মনে রাখতে হবে, নারীর একক প্রচেষ্টায় নারী-শিশুবান্ধব সমাজ গড়ে উঠবে না। নারী অধিকার, মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে; সমতাভিত্তিক সমাজ গড়তে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি নারী-পুরুষের সম্মিলিত সামাজিক-সাংস্টৃ্কতিক আন্দোলনের বিকল্প নেই।
বলা আবশ্যক, সামাজিক মাধ্যমসহ পত্রপত্রিকায় বোরকা-হিজাবের বিরুদ্ধাচরণ দেখছি। 'প্রগতিশীল ভাবনা' থেকে এই বিরুদ্ধাচরণ- তা কতটুকু সংগত? আমার মতে, পোশাকের পরিচয়ে নারীসমাজের মধ্যে এই বিভাজন গ্রহণযোগ্য নয়। যারা বোরকা বা হিজাব পরে শিক্ষালয় ও কর্মস্থলে যাচ্ছে, তাদের অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। তাদের একচেটিয়া গোঁড়া ভাবারও কোনো কারণ নেই। পারিবারিক সেন্টিমেন্ট বা পারিপার্শ্বিকতার কারণে অনেককে বোরকা-হিজাব পরতে হচ্ছে। অনেকেই নিরাপত্তার কারণে বোরকা-হিজাব পরছে। এতে নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, কেউ সে বিতর্ক করতেই পারেন। কিন্তু অনেক তরুণী-কিশোরী যে নিরাপত্তাবোধ থেকে বোরকা-হিজাব পরছে- তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। আবার পোশাকের জীর্ণ দশা আড়াল করতে অনেককে বোরকা পরতে হয় এবং হচ্ছে। বোরকা-হিজাব এক ধরনের রেওয়াজও হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার পরিচিতদের কারও কারও কাছে শুনেছি, আশপাশের সবাই পরে, তাই আমিও পরি।
প্রসঙ্গক্রমে, আমি একবার পুরান ঢাকায় অবস্থিত সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে জার্নালিজম বিভাগের ক্লাস নিতে আমন্ত্রিত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে দেখলাম, মেয়েরা দলে দলে বোরকা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটছে। ক্লাসরুমে গিয়ে দেখলাম, বোরকা পরিহিত একজনও নেই। শ্রেণিকক্ষে ওরা ছিল উচ্ছল, প্রাণবন্ত। আমি প্রথমেই বললাম, রাস্তায় বোরকা পরা যে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসতে দেখলাম, ওরা গেল কোথায়? সবাই হাসতে লাগল। একজন দাঁড়িয়ে বলল, 'স্যার, আমরা বেশিরভাগই পুরান ঢাকার মেয়ে। আমাদের অভিভাবকরা চান না যে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। অনেক বলে-কয়ে রাজি করিয়েছি। বোরকা ছাড়তে গেলে আমাদের লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যাবে।' অন্যরা ওর বক্তব্য সমর্থন করল। আমি বললাম, শিক্ষার জন্য আরও কঠিন কোনো পোশাকও যদি পরতে হয়, তাও পরো; কিছুতেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ো না।
আমাদের গ্রামের কলেজেও বেশিরভাগ মেয়ে হিজাব পরে। একবার এক বন্ধু কলেজটি পরিদর্শনের পর মেয়েদের হিজাব পরার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওদের পোশাক সচেতন হতে বলো না কেন? আমি তাকে বলেছিলাম, শিক্ষার আলো জ্বালানোই এখন বড় কাজ। এমন কিছু বিপ্লবীপনা করা যাবে না, যাতে আসল কাজ ব্যাহত হয়।
পর্দা সম্পর্কে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ও বেগম রোকেয়ার উপলব্ধির মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। সর্দার ফজলুল করিমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন, একবার তিনি বোরকা পরে বেগম রোকেয়ার কাছে গেলেন। বেগম রোকেয়া বললেন, ফুলকবি (তিনি কবি সুফিয়া কামালকে আদর করে ফুলকবি বলে ডাকতেন), তুই কেন এমন পর্দা করেছিস? সুফিয়া কামাল বললেন, আপনিও তো পর্দা করেন। বেগম রোকেয়া বলেন, আমি পর্দা মেনে চলার পরও আমার ওপর ধর্মান্ধদের কী আক্রোশ! আর পর্দা না মানলে কি মূল কাজটা করতে পারতাম? বেগম রোকেয়ার মূল কাজ ছিল শিক্ষার আলো জ্বালানো; আর সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের মূল কাজ শিক্ষিত হওয়া। বেগম রোকেয়াকে শিক্ষার আলো জ্বালানোর প্রয়োজনে পর্দা করতে হয়েছে; আর সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের সেই আলোকে স্নাত হতে পর্দা বরণ করতে হচ্ছে। উভয়ের লক্ষ্য ও কৌশল অভিন্ন।
বোরকাকে ছাড়িয়ে এখন হিজাবের দাপট। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় হিজাবের প্রসার ঘটিয়েছে ৯/১১। এই ঘটনার পর যখন মুসলিম নারীরা রাস্তা, রেস্তোরাঁ, বিমানবন্দরে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে থাকল, নানা কটূক্তি শুনতে হলো; তখন তারা হিজাব পরে স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরল। অনেক মেয়ে স্কার্ট ছেড়ে হিজাব পরতে শুরু করল। এ যেন ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কোর্ট-প্যান্ট ছেড়ে স্বদেশি পোশাক পরার মতো প্রতিবাদ। হিজাব এখন ইউরোপ-আমেরিকার মুসলিম নারীদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এই প্রতিবাদের ঢেউ পাশ্চাত্যে সীমাবদ্ধ নেই। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেই হাওয়া বাংলাদেশেও লেগেছে।
সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটকে একটি কলেজে হিজাব না পরার নির্দেশ দিলে মুসলিম ছাত্রীরা প্রতিবাদ করে। এই প্রতিবাদকে আমলে নেওয়া হয় না। প্রতিবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের নানা স্থানে। হিন্দু শিক্ষার্থীদের একাংশ তাদের মুসলিম সহপাঠীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সভা-সমাবেশে যোগ দিয়েছে। ভারতের অনেক মুসলিম নারীর কাছে বিষয়টি পাশ্চাত্যের মতোই। সেখানেও হিজাব মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে হিজাবের বিষয়টি আলাদা। এর সঙ্গে কিছুটা ধর্মীয় অনুভূতি হয়তো আছে। তবে সব ছাড়িয়ে হিজাব এখন ফ্যাশন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মুসলিম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্যাশন।
অতীতে আমরা টুপি-টিকিতে দ্বন্দ্ব দেখেছি; লুঙ্গি-ধুতিতে লড়াইয়ের পরিণতি দেখেছি। এখন আর 'হিজাবি', 'নন-হিজাবি' বিতর্ক শুনতে চাই না। টিপ ও হিজাব নিয়ে কটাক্ষ শুনতে চাই না। পোশাক পছন্দ ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। কে কোন পোশাক পরবে- শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, না প্যান্ট-শার্ট; টিপ পরবে কি পরবে না, হিজাব পরবে কি পরবে না, তা ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। পোশাক পছন্দ করা প্রত্যেকের অধিকার। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সমাজের কিছু বলার থাকতে পারে না।
পোশাকের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মানুষে মানুষে সংহতির সেতুবন্ধ রচনাই সময়ের দাবি। এমন কিছু করা কাম্য নয়, যাতে সম্প্রীতির বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হয়; শিক্ষা ও উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়।